খবর সোজাসুজি

চোখে চোখ রেখে কথা বলে !!!
Khabor Sojasuji Logo_200x120
চোখে চোখ রেখে কথা বলে !!!

একটি জ্বলন্ত সমস্যা

পার্থ পাল

গ্রামের ভোর। আপনি হাঁটতে বেড়িয়েছেন। দৃশ্যকল্পটি ভাবলেই মনটা কেমন ভালো হয়ে যায়, তাই না? বাস্তবে কিন্তু তা হওয়ার নয়। বিশেষ করে এই নভেম্বর মাসে। বিগত কয়েক বছরে এই সময়টিতে গ্রামের বাতাস এতটাই ধোঁয়াক্রান্ত থাকে যে, খানিক জোরে হাঁটলেই হাঁফ ধরে যায়। নাড়া পোড়ানোই এর প্রধান কারণ। নভেম্বরের শুরুতেই গ্রামাঞ্চলে আমন ধান কাটা শুরু হয়। শেষও হয়ে যায় কয়েকদিনেই। হবে নাই বা কেন, এখন তো কাস্তেতে ধান কাটার রেওয়াজ নেই বললেই চলে। একটা কম্বাইন হারভেস্টর এক ঘন্টায় এক একর জমির ধান কেটে, সব ধানকে বস্তাবন্দি করে দিচ্ছে। চাষী ভাইয়েরাও সরাসরি বা কিষান মান্ডিতে ধান বিক্রি করে দিয়ে মূল্য বুঝে নিচ্ছেন। ঝক্কি ঝামেলার শেষ। এবং সেখানেই সমস্যার শুরু। হারভেস্টরে ধান কেটে দিয়ে যাওয়ার পর জমিতে পড়ে থাকে কুঁচনো ধানগাছ বা নাড়া। দেখা গেছে, এক একর জমিতে ১২ থেকে ১৬ কুইন্টাল নাড়া পড়ে থাকে। চাষীভাইয়েরা এই পড়ে থাকা আবর্জনায় আগুন দিয়ে দেন। কিছু সময়ের মধ্যেই তা পুড়ে ছাই হয়ে যায়। কৃষিবিজ্ঞানীদের মতে দশ কুইন্ট‍্যাল নাড়া পুড়লে ১৪৬০ কিলোগ্রাম কার্বন ডাই অক্সাইড, ৬০ কিলোগ্রাম কার্বন মনোক্সাইড এবং ২০০ কিলোগ্রাম ছাই উৎপন্ন হয়। এছাড়াও বাতাসে মেশে ক্ষতিকর সালফার ডাই অক্সাইড ও মিথেন গ্যাস। এভাবেই দূষিত হয় নির্মল বাতাস। বিকালবেলায় গ্রামের মাঠগুলিকে যুদ্ধক্ষেত্র বলে ভ্রম হয়। চারিদিকে কেবল লেলিহান আগুন আর কালো ধোঁয়া। এই ধোঁয়াই বায়ুবাহিত হয়ে পৌঁছে যায় শহরে। স্বাভাবিক অবস্থাতেই দূষিত শহর এর ফলে বসবাসের অযোগ্য হয়ে ওঠে। বিগত কয়েক বছরে নভেম্বর মাসে দিল্লি শহরের বায়ুদূষণ সহনমাত্রা অতিক্রম করে। বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে নগর জীবন। যা আমাদের সকলেরই জানা। এসব জেনেও চাষীরা কেন নাড়া পোড়ান? আমন ধানের পরেই এখানে আলু চাষ শুরু হয়। নভেম্বর মাসের মধ্যেই আলু বীজ না বসাতে পারলে পাকা আলুগাছ নাবিধসা রোগের শিকার হবে। উৎপাদন ভালো হবে না। এদিকে আমন ধান পাকতেও নভেম্বরের প্রথম পক্ষ হাজির হয়। তাই ধান কাটা ও আলু বসানোর মধ্যে সময়ের ব্যবধান নেই বললেই চলে। জমিকে তাড়াতাড়ি তৈরি করতে হলে নাড়ার ব্যবস্থা তাই করতে হয় দ্রুত। যা পুড়িয়ে ফেলাই চাষীদের কাছে সহজতম পথ। এই সহজ পথ ধরতে গিয়েই অন্য ফাঁদে পড়ছেন তাঁরা। প্রথমত বায়ু দূষিত হচ্ছে যা পরিবেশের সঙ্গে ক্ষতি করছে তাঁর ও তাঁর পরিবারকেও। দ্বিতীয়ত ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে মাটির স্বাভাবিক প্রকৃতি। মাটির উপরে আগুন জ্বললে ছয় ইঞ্চি গভীরতা পর্যন্ত মাটির উর্বরতা নষ্ট হয়। অসুস্থ হয়ে পড়ে মাটি। কেঁচো, বন্ধু পোকামাকড়, জীবাণু বা অনুখাদ্য ইত্যাদি পুড়ে যায়। তখন ফসল ফলাতে, গাছের খাদ্য দিতে প্রয়োগ করতে হয় রাশি রাশি রাসায়নিক সার। তাতে সার্বিকভাবে ব্যয় বাড়ে; উৎপাদন কমে। আফসোস করেন চাষী। এখন প্রশ্ন হল, এমন সমস্যা থেকে উদ্ধারের উপায় কি? দেখা গেছে যন্ত্রে ধান কাটলে বিঘা প্রতি চার হাজার টাকা সাশ্রয় হয়। অথচ আধুনিক ছোট যন্ত্রে গাছ সমেত ধান কেটে তা খামারে এনে ধান ও খড় আলাদা করলে খড়ের দাম বাবদ যা আয় হবে, তা ব্যয়ের তুলনায় অনেক বেশি। চাষীরা এত ঝামেলায় যেতে না চাইলে বেলার যন্ত্রের সাহায্যে নিতে পারেন। এই যন্ত্রটি পড়ে থাকা নাড়াকে অল্প জায়গায় জড়ো করে দিতে পারে। যা পরে বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা যায়। তবে সবচেয়ে বিজ্ঞানসম্মত উপায় হল সরকারের সরবরাহ করা শক্তি ক্যাপসুল এর ব্যবহার। ‘পুসা ডিকম্পোজার’ নামের এই ক্যাপসুলগুলিতে থাকে বিভিন্ন জৈব উপাদান – যেমন অ‍্যাসপারজিলাস নিডুলাস, ট্রাইকোডারমা ভিরিডে ইত‍্যাদি। জল ও গুড়কে গুলে, উত্তপ্ত করে তার সঙ্গে ছাতু ও ক্যাপসুল মিশিয়ে একটি জৈব মিশ্রণ তৈরি করা হয়। যা নাড়াপূর্ণ জমিতে ছড়িয়ে দিলে দশ থেকে পনেরো দিনের মধ্যে সব নাড়া পচে যাবে। এতে পরিবেশ নির্মল থাকার পাশাপাশি খরচ যেমন বাঁচবে, তেমনই মাটির স্বাস্থ্যও থাকবে ভালো। যা ভালো ফসল পাওয়ার প্রধান শর্ত।

Share this on social media

Facebook
Twitter
Email
WhatsApp
Telegram
Pinterest

Recent Posts