খবর সোজাসুজি

চোখে চোখ রেখে কথা বলে !!!
Khabor Sojasuji Logo_200x120
চোখে চোখ রেখে কথা বলে !!!

শ্রদ্ধা নাকি কুসংস্কার?আজও মাটিতে শোওয়ার ইতিহাস বয়ে বেড়ায় পীরপাল!

সংবাদদাতা – জয়দীপ মৈত্র, দক্ষিণ দিনাজপুর: কুসংস্কার নাকি শ্রদ্ধা ? তারই জেরে গোটা গ্রাম এখনও খাট ব্যবহার করেন না। শুয়ে থাকেন মাটিতে। কুসংস্কারে বিশ্বাসী হয়ে হোক বা শ্রদ্ধায়, এখনও পর্যন্ত কাঠের তৈরি চৌকি বা খাটে কেউই ঘুমোন না।দক্ষিন দিনাজপুর জেলার গঙ্গারামপুর ব্লকের বেলবাড়ি গ্রাম পঞ্চায়েতের পীরপাল গ্রামে এটাই দস্তুর। দেশ এগিয়ে চলেছে।কত রকমারি খাট ব্যবহার করেন দেশের মানুষ।কিন্তু পীরপালের মানুষ তা থেকে অনেক দূরে। যদি কারও খাটে শোবার ইচ্ছে হয়, তাহলে মাটির তৈরি খাট বানিয়ে নেন। নতুবা মাটিতেই ঘুমোন সকলে।

কেন? তার পিছনে রয়েছে এক ইতিহাস। স্থানীয় বাসিন্দাদের মুখে মুখে ফেরে তা। জনশ্রুতি অনুযায়ী, ১৭০৭ সালে পীরপালের মাটিতে ইখতিয়ারউদ্দিন মহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজির দেহ নাকি সমাধিস্থ করা হয়।এরপর তিনি দেবতা বা পীর রুপে আবির্ভূত হন। এমনটাই বিশ্বাস গ্রামবাসীদের।বীর যোদ্ধা মাটিতে শায়িত অথচ গ্রামবাসী খাটে শোবেন? তা কী হতে পারে। গ্রামবাসীদের বিশ্বাস, গ্রামবাসীরা খাটে বা চৌকিতে ঘুমোলে তাদের কাছে নাকি স্বপ্নাদেশ আসে। এমনকী, মেরে ফেলারও ভয় দেখানো হয়। আর সেই ভয়েই পীরপালের মানুষ চৌকি বা খাটে শোন না। গ্রামের আনাচে কানেচ এও শোনা যায়, যাঁরা জনশ্রুতি অমান্য করে খাট ব্যবহার করেছিলেন, তাঁদের কেউ কেউ নাকি অসুস্থ হয়েও পড়েন।স্বাভাবিকভাবেই ভয় আরও চেপে বসে মনে। গ্রামবাসীরা জানালেন, এসব দেখে কে ঝুঁকি নেবে বলুন। পরিবারের সকলে অসুস্থ হয়ে পড়লে দু’একদিনের শোওয়ার সুখ নিয়ে কী লাভ ?

তবে ইতিহাসবিদরা অবশ্য বিষয়টিকে অন্যভাবে ব্যাখ্যা করছেন।ইতিহাসবিদদের মতে, স্বপ্নাদেশ বা ভীতি নয়। বখতিয়ার খলজি ছিলেন বীর। সেই বীরকে শ্রদ্ধা জানাতেই গ্রামবাসীরা মাটিতে শোন। কারণ, মাটিতেই যে সমাধিস্থ করা হয়েছিল সেই বীরকে।জেলার ইতিহাসবিদরা জানাচ্ছেন, ১৭০৭ সালে সুলতানি রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে বখতিয়ার খলজি পাল বংশের লক্ষন সেনকে পরাজিত করে সংগ্রামপুর,দেবীকোট সহ গোটা গৌড় দখল করে নেন। লক্ষন সেন প্রাণ নিয়ে পালিয়ে তৎকালীন বঙ্গে পালিয়ে যান এবং তার সৈনরা পরাজিত হয়ে নদিয়া শহর পর্যন্ত ত্যাগ করতে বাধ্য হন। অন্যদিকে, তিব্বত ও কামরূপ অভিযান বিফল হয়। সৈনবাহিনীও ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরাজয়ের গ্লানি সহ্য করতে না পেরে বখতিয়ার খলজি অসুস্থ হয়ে পড়েন।আর তাঁকে ঘুরে দাঁড়াতে হয়নি।শয্যাশায়ী অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয় অল্প কিছুদিনের মধ্যে।বাংলার ১২০৬ বঙ্গাব্দে (ইংরেজি ১৭০৭ খ্রীষ্টাব্দে) তাঁর মৃত্যু হয়।বখতিয়ার খলজির মৃত্যুর পিছনে তার প্রধান সেনাপতির হাত ছিল বলেও অনেকে মনে করেন।বখতিয়ারের মৃত্যুর পর পীরপালে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়।যেহেতু তিনি বীরযোদ্ধা ছিলেন তাই তিনি পীর রুপে আবির্ভূত হন বলে গ্রামবাসীরা মনে করেন। তারপর থেকে এলাকার, বিশেষ করে বয়স্করা, চৌকি অথবা খাটে ঘুমোন না। যদিও এই জনশ্রুতি মানতে নারাজ জেলার ইতিহাসবিদ সুমিত ঘোষ।তাঁর যুক্তি, বখতিয়ার খলজি বীরযোদ্ধা ছিলেন। তাঁকে সম্মান জানাতেই পীরপালের মানুষ মাটিতে ঘুমোন।তবে এটাও ঠিক, এলাকার মানুষের মধ্যে কিছু কুসংস্কার রয়েছে।পীরপালের বয়স্ক ব্যক্তি রাজেন রায়, চন্দন রায় জানান,”কয়েকশো বছর আগে থেকে এই গ্রামের মানুষ মাটিতে ঘুমোয়। স্বপ্নাদেশের ভয়েই চৌকি বা খাটে কেউ ঘুমোন না।কেউ আবার জোর করে খাট ব্যবহার করলে পরিবারের সকল সদস্য অসুস্থ হয়ে পড়ে”।

শ্রদ্ধাই হোক বা স্বপ্নাদেশের ভয়, ইতিহাসের বীর যোদ্ধাকে যে এখনও মনে রেখেছেন গ্রামের মানুষ, তার প্রমাণ কিন্তু মাটিতে শোওয়ার চল।

Share this on social media

Facebook
Twitter
Email
WhatsApp
Telegram
Pinterest

Recent Posts