তন্ময় কবিরাজ
লোকসভা ভোটের আগে রাজনীতিতে চমকের অভাব নেই।কেউ রাজ্যপালকে কুকথা বলছে,তো কেউ নির্বাচন কমিশনকে মেসো,আম্পায়ার, উদ্ধত বলে সম্বোধন। আবোল তাবোলের ছড়াছড়ি। আইপিএলের দোসর হিসেবে তাই নাগরিক সমাজ মজা নিচ্ছে আর নিজেরাই অবাক হয়ে ভ্রান্তিবিলাসের সিক্যুয়েল তৈরি করছে। যে সব প্রার্থী আজ ভোটে লড়ছে তারাই ভোটে জিতলে সংবিধানের নামে শপথ নিয়ে মানুষের জন্য কাজ করবে। অথচ ভোটের আগে তাঁদের বেশিরভাগকেই দেখা যাচ্ছে সংবিধানকে অমান্য করতে। অনন্ত হেগরের মত নেতা তো সংবিধান বদলের পক্ষেই মত দিয়েছেন। পরিস্থিতি এমন জায়গায় গেছে যে রাষ্ট্রপতিকে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় আর শাসক চেয়ারে বসে থাকে।মানুষের মন জয় করার কতো রকম আইডিয়া,কেউ সাধারণ মানুষের সঙ্গে মাঠের আলে বসছে,কেউ রিয়্যালিটি শোতে নিয়ে যাবার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে,কেউ গরীবের বাড়িতে খাচ্ছে,কেউ তেলেভাজা দোকানে বেগুনি ভাজছে,আরো কত কি!নির্বাচন কমিশন এবার খুব কড়া,অনেকেই সেটা বলছেন।সংবাদমাধ্যমের সামনে ফোর এম থিওরি তুলে ধরেছে সুষ্ঠ ভাবে নির্বাচন পরিচালনা করার জন্য। অথচ সেই নির্বাচন কমিশনের নিয়োগ সঠিকভাবে হয়নি বলে মন্তব্য করেছেন বিচারপতি সঞ্জীব খান্না, এবং বিচারপতি দীপঙ্কর দত্ত। রাজনীতিই এখন শেষ কথা। নেতারা প্রকাশ্যেই বলছে, তারা টিকিট পাবার জন্যই রাজনীতিতে এসেছে।তাই ভোটের টিকিট না পেলে কেউ অভিমানী হয়ে মিডিয়ার সামনে মুখ খোলে তো কেউ দল পাল্টে রাতারাতি ভোটের টিকিট পেয়ে প্রার্থী হয়ে যায়। গার্ডেনরিচ থেকে উত্তরবঙ্গের ঝড়ের ব্যাপক ক্ষতি,প্রাণহানি হবার পরেও রাজনীতি কিন্তু থামেনি। দিলীপ ঘোষ যখন প্রাকৃতিক ঝড়কে বিজেপির ঝড় হিসাবে দেখছেন তখন অভিষেক বন্দোপাধ্যায় বলছেন, আবাসের টাকা পেলে এতো ক্ষয়ক্ষতি হত না। ত্রাণ নিয়েও চলছে রাজনীতির তরজা।সেই কবে কবি কুমুদ রঞ্জন মল্লিক লিখেছিলেন,”… রিলিফ আসিছে ভিক্ষা আলিছে কম্বল পিছু পিছু।”ব্যক্তি আক্রমণ, শরীর নিয়ে আক্রমণ সব চলছে দেদার।এখন আর ইস্যু, আদর্শ দিয়ে ভোট হয়না।মানুষকে বিভ্রান্ত করে ভোটটা আদায় করতে পারলেই কেল্লা ফতে। নির্বাচনী বন্ড নিয়ে যখন চারদিকে এতো হইচই, এমনকি পরকলা প্রভাকর বলছেন,এটা বিশ্বের বৃহত্তম দুর্নীতি, তখন মোদি বলছেন, যারা আজ নির্বাচনী বন্ড বন্ধ করা নিয়ে গর্ব করছে, তারাই কাল অনুতপ্ত হবে।আর গড়করি তো পরিষ্কার করে বলেই দিয়েছেন, যাদের টিআরপি বেশি তাদের অনুদানও বেশি।এখন ভোটের ইস্যুর হলো রাজা কৃষ্ণচন্দ্র বা কচ্ছতিবু দ্বীপ। এসব ভোটের এজেন্ডা হওয়ার অর্থ ভোটের পরে এসবই চলবে। সৌগত রায় বলছেন, সুজন চক্রবর্তীর সব চুল কার্বাইডে পাকানো। সদ্য অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি অভিজিৎ গাঙ্গুলি রাজনীতির ভাষাটা ভালোই রপ্ত করছেন।তাই লক্ষ্মী ভান্ডার থেকে শুরু করে চন্দ্রবোরা- বিভিন্ন সময়ের তাঁর রাজনৈতিক উপমা বেশ চলছে! পীযুষ গোয়েল যতোই বলুক না কেন, তাঁর দল জাতপাত বা বিভাজনের রাজনীতি করে না, কেরলে গিয়ে মোদি যেভাবে ধর্মের উস্কানি দিয়েছেন বা বাংলার জঙ্গলমহলেও যে বিভাজনের রাজনীতি চলছে তাতে পীযুষ গোয়েলের যুক্তি কতটা টিকবে সে বিষয়ে সন্দেহ রয়েছে। রাজ্যপালদের অন্তত রাজনীতির বাইরে থাকা উচিত।কিন্তু সেটাও বা হচ্ছে কোথায় ? কিছু বিল আটকে রাখার জন্য রাজ্যপালের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বিচারপতি বি ডি নাগারত্ন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের যখন মাথায় ব্যান্ডেজ নিয়ে প্রচার করছেন, তখন দিলীপ ঘোষ বলছেন, মুখ্যমন্ত্রী কপালের স্টিকার কবে খুলবে? অবাককান্ড, তদন্তকারি সংস্থার উপর কারো আর আস্থা থাকছে না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যেমন তাঁর প্রার্থীদের বলছেন, এজেন্সি ডাকলে বলুন ভোটের কাজে ব্যস্ত।গত পাঁচ বছরের অনেক মহিলা নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে সেটা মণিপুর হোক বা সন্দেশখালি।ভোটের আগে তাই সেই মহিলাদের মন পেতে কেউ প্রকল্পের টাকা দ্বিগুণ করছে ,তো কেউ গ্যাসের দাম কমাচ্ছে বা শক্তিস্বরুপা সন্মান দিচ্ছে। কংগ্রেস তো বলছে ক্ষমতায় এলে ৫০শতাংশ সংরক্ষণ হবে মহিলাদের। চারদিকে এখন গ্যারেন্টি চলছে।কেউ বলছে , শাজাহান এখন ক্লোজড চ্যাপ্টার।কিন্তু এই শাহাজান যে আবার আসবে না তার গ্যারেন্টি কিন্তু কোনো দলই দিতে পারছে না।তাই ভোটের স্লোগানে ডেডলাইন, হেডলাইন যতোই থাকুক, আসলে কিন্তু মানুষের যে দুর্গতি সেই দুর্গতিই থাকবে।তাই একজন নাগরিক এক ভোট প্রার্থীকে প্রশ্ন করে,”ভোটের পর আপনাকে এলাকাতে দেখতে পাবো তো?”এতটাই অবিশ্বাস জন্মেছে নাগরিক মনে, তার দায় কিন্তু রাজনীতিকেই নিতে হবে। অন্যদিকে,একদল আইনজীবি রাজনৈতিক দলের হয়ে প্রচার করছে,আবার আর একদল আইনজীবি সেই দলের বিরুদ্ধেই দেশের প্রধান বিচারপতির কাছে চিঠি পাঠিয়েছেন। ভোটের সময় কে কার পাশে বোঝা মুশকিল।এমনিতেই নেতারা যেকোনো সময়েই ডিগবাজি খেতে পারে, বিক্রি হয়ে যেতে পারে। সিবিআই তৃণমূলের ঘরে হানা দিলে কংগ্রেস সিবিআইকে সমর্থন করে কিন্তু সিবিআই ভোটের আগে তৃণমূলের নেতা নেত্রীকে ডেকে পাঠালে কংগ্রেস তৃণমূলের পাশে দাঁড়ায়।কেউ কাউকে মানছে না এখন। আগে সংবাদমাধ্যমের ক্যামেরা দেখে তাও ভয় পেত, এখন তাও পায় না। কারন নেতাদের কাছে সংবাদমাধ্যম “দু পয়সার”।তাই সুযোগ পেলেই সাংবাদিককে মিথ্যা মামলায় জেলে ভোরে দেয় শাসক।যে কেজরিওয়াল একদিন বলেছিলেন,”স্বামী মোদি ভক্ত হলে স্বামীর সঙ্গে রাতে খাবেন না”,আজ সেই কেজরিওয়াল জেলে। কেজরিওয়াল বলেছিলেন,”আমরা যদি কোনোদিন দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে যাই, তাহলে আদর্শ নষ্ট হয়ে যাবে।”আজ সেই কথাগুলো খুব ভাইরাল হচ্ছে। গ্রেফতারিতে রাজনীতি আছে কিনা সেটা বলা ঠিক নয়,কারন মিডিয়া ট্রায়ালে অংশ না নিয়ে আইনের উপর ভরসা রাখাই উচিত, যদিও জার্মানি থেকে আমেরিকা সবাই এই গ্রেফতারির পরে সরকারের উপর বিরক্ত প্রকাশ করেছে। রাজনীতি এমনই একটা শিল্প,এখানে নিশ্চিত করে কিছুই বলা যাবে না। তাই আগে সেটিং শোনা যেতো ,এখন শোনা যায় ম্যাচ ফিক্সিং।রাজনীতিতে কেউ আদর্শ নিয়ে হয়তো ভাবে না,ভাবলে মানুষের মনের খবর রাখতো। ইম্ফলে সবাই একজোট হচ্ছে,ভোট দিলে নোটায় ভোট দেবে তারা। জনগন জানে এভাবেই চলছে, এভাবেই চলবে। তারা যতোই শিক্ষিত হোক, ভোটের পরে তারাই বোকা হয়ে যাবে। শাসক যেই আসুক অবস্থার পরিবর্তন হবে না। ভারত পঞ্চম থেকে তৃতীয় অর্থনীতির দেশ হবে আগামীতে, দেশের বেশির ভাগই থাকবে উচ্চ মধ্যবিত্ত।কিন্তু তাতে কি বেকারত্ব কমবে? অনাহার কমবে,? শিক্ষা স্বাস্থ্যের হাল ফিরবে? তথ্য বলছে,২০৫০সালের মধ্যে ভারতে প্রতি পাঁচ জনের মধ্যে একজন হবে প্রবীন যার বয়স হবে ৬০।অপরদিকে, ল্যানসেট বলছে,২১০০সালের মধ্যেই ফাঁকা হয়ে যাবে পৃথিবী।মাঝের এই কটা বছর মানুষকে কি একটু ভালো রাখতে পারে না শাসক ?