খবর সোজাসুজি

চোখে চোখ রেখে কথা বলে !!!
চোখে চোখ রেখে কথা বলে !!!

বিবাহ,বিচ্ছেদ বনাম আদালত

তন্ময় কবিরাজ

বিবাহ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন,সভ্য সমাজের অন্যান্য সব ব্যাপারের মতই প্রকৃতির অভিপ্রায়ের সঙ্গেই মানুষের অভিপ্রায়ের সন্ধি স্থাপনের ব্যবস্থা।অন্যদিকে,সমাজবিজ্ঞানী এন্ডারসন ও পার্কার বলেছিলেন, বিবাহের মধ্যে যেমন উৎসব রয়েছে তেমনই সে উৎসবের আড়ালে রয়েছে সামাজিক ও ব্যক্তিগত জীবনের মাপকাঠি।বিচারপতি নগরথনা ও বিচারপতি মসিহ বিবাহের পবিত্রতা রক্ষার জন্য সপ্তপদীর কথা উল্লেখ করেছেন।প্রয়োজনীয় রীতিনীতি পালন না করলে সে বিবাহকে বৈধ বলে স্বীকার করা হবে না বলে মন্তব্য করেন বিচারপতিরা। পর্যবেক্ষণে তাঁরা বলেছেন, বিবাহ মানে শুধু খাওয়া দাওয়া আনন্দ অনুষ্ঠান নয়,তার সঙ্গে প্রথার গভীর সম্পর্ক রয়েছে।বিবাহের পূর্বে তাই বিবাহ সম্পর্কে সেই পবিত্রতার কথা জানা দরকার।উল্লেখ্য যে ঋকবেদ অনুসারে, সপ্তপদীর মধ্যে দিয়েই নারী পুরুষের বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠে যা অবিচ্ছিন্ন, স্ত্রী হয়ে উঠে অর্ধাঙ্গিনী।বলা বাহুল্য, বর্তমান সমাজ পরিস্থিতিতে যখন প্রথা ভাঙার রীতি চলছে চারদিকে, নিজেদের ঐতিহ্যকে ভুলে যাচ্ছে সবাই,তখন দেশের বিচারব্যবস্থা সেই প্রথাকেই মনে করিয়ে দিতে চাইছে। প্রথা একটা দীর্ঘদিনের বৈধ অভ্যাস, তাকে অবজ্ঞা করা যায় না। প্রথা থেকেই আইনের জন্ম হয়।দেশের আদালত মানুষের জৈবিক সুখের পথে যেমন অন্তরায় হয়নি,তেমনি বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানের পবিত্রতার রক্ষা করতেও তাঁরা বদ্ধ পরিকর। দিল্লী হাইকোর্ট বলছে,পরিণত বয়সে লিভ ইন সম্পর্কে কেউ হস্তক্ষেপ করতে পারবে না,এমনকি তা ফৌজদারি আইনে আনাও ঠিক নয়।আসলে বিচারব্যবস্থা বোঝাতে চেয়েছে,কেউ যদি লিভ ইন সম্পর্কে থেকে সুস্থ ভাবে জীবন কাটাতে পারে তো ভালো কিন্তু তাকে সেই সম্পর্কের বৈবাহিক রূপ দিতে হলে প্রচলিত প্রথা মেনেই করতে হবে।নিজের ব্যক্তি স্বাধীনতার দাবিতে কেউ প্রচলিত প্রথাকে কালিমালিপ্ত করে অন্যের ভাবাবেগে আঘাত হানতে পারে না।অধিকার কর্তব্যের সম্পর্ক রয়েছে দুয়ের মধ্যে।দেশের আদালত বিবাহের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে বলছে,এক কথায় সেলফ রেসপেক্ট ম্যারেজ।সমাজবিজ্ঞানী রস মনে করতেন, বিবাহ একটি পবিত্র,ব্যক্তিগত ও সামাজিক চুক্তি।যদিও ভারতীয় আইনে বিবাহ সম্পর্কে চুক্তির ধারণা নেই।বরং পবিত্রতা উত্তরণের গল্পে আবদ্ধ স্বামী স্ত্রীর মধুর সম্পর্ক।তাই মর্গ্যান যখন বলেন, বিবাহ আইনগত গণিকাবৃত্তি তখন তা ভারতীয় প্রথার বিরুদ্ধে।দেশের আদালত বিবাহ সম্পর্কে তাঁদের মতামত ব্যক্ত করতে গিয়ে বুঝিয়েছেন, বিবাহের একটা শাস্ত্রীয় ইতিহাস রয়েছে, সেটাও জানা দরকার।সারা পৃথিবী তথা দেশেও ক্রমাগত বাড়ছে বিবাহ বিচ্ছেদের সংখ্যা,যা চিন্তার।পরিবার তার অস্তিত্ব হারাচ্ছে।জীবন ক্রমশ পরিযায়ী হয়ে পড়ছে।মানুষ দিন কাটাচ্ছে ডিপ্রেশনে।

বিবাহ বিচ্ছেদ আজকাল সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে।বিশ্বের নিরিখে ভারতে বিবাহ বিচ্ছেদের হার কম হলেও অতি সাম্প্রতিক কিন্তু সংখ্যাটা ক্রমশ বাড়ছে।দেশে বিবাহ বিচ্ছেদের হার ১.১ শতাংশ থেকে বেড়ে ১.৬ শতাংশ,যেখানে সুইডেনে ৫৪.৯ শতাংশ,আমেরিকাতে ৫৪.৮শতাংশ,জাপানে,১.৯শতাংশ।দেশের মধ্যে মহারাষ্ট্রে বিবাহ বিচ্ছেদের হার বেশি ১৮.৭ শতাংশ। দ্বিতীয় কর্ণাটক ১১.৭ শতাংশ,উত্তরপ্রদেশ ৮.৮শতাংশ, পশ্চিমবঙ্গ ৮.২,শতাংশ।দিল্লি,মুম্বাই, চেন্নাইতে বিবাহ বিচ্ছেদের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে।আগের তুলনায় হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩০ শতাংশ।সমাজ বদল হচ্ছে। সমানুপাতিক হারে বাড়ছে জীবনের চাহিদা।জীবন এখন বর্ণময়।মানুষের কাছে বিকল্প রয়েছে।তাই স্থির জীবনে তার আর আস্থা নেই।একপেশে জীবন থেকে মুক্তি পেতে সে চেনা সম্পর্ক ভাঙতে চাইছে বারবার।ফলে বৈবাহিক জীবনে ফাটল ধরছে।কারণ হিসাবে অনেকেই মনে করছেন, বিশ্বাসের অভাব, যোগযোগ নেই, ক্রমবর্ধমান চাহিদা,আর্থিক নিরাপত্তা,কাজের চাপ, বেলাগাম জীবন যাত্রা।মানুষ আজ আর দায় দায়িত্ব গ্রহণ করতে চাইছে না।সে অবাধ স্বাধীনতা ভোগে ইচ্ছুক।ফলে সাবেক পরিবার প্রথা ভেঙে পশ্চিমী ধাঁচের জীবনযাপনে আগ্রহী। অতি সাম্প্রতিক অচিন গুপ্ত বনাম হরিয়ানা রাজ্য মামলায় আদালত বলেছে,বিবাহকে টিকিয়ে রাখতে হলে সহ্য ক্ষমতা,পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেবার ক্ষমতা ও একে অন্যের প্রতি শ্রদ্ধা থাকা দরকার।আদালত আরও বলছে, সাংসারিক জীবনের ছোটখাটো বিষয়গুলোকে সবসময় বড়ো করে দেখতে নেই কারণ তিলকে তাল করলে তার নেতিবাচক প্রভাব বৈবাহিক সম্পর্কের মধ্যে এসে পড়ে। তাছাড়া, কথায় কথায় পুলিশ ডাকাও উচিত নয়।বরং পারিবারিক মধ্যস্থতার মাধ্যমে সমাধান করা উচিত।

আদালত সবসময় চেষ্টা করছে যাতে বৈবাহিক সম্পর্ক নষ্ট না হয়,তার পবিত্রতা রক্ষা পায়।সমাজ ও জীবনের মধ্যে ভারসাম্য রাখতে গিয়ে আদালতও কখনও কখনও তাঁর মনোভাব বদল করেছে।২০০৭ সালে সুপ্রীম কোর্ট বিবাহ রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক করেছিল কারণ তখন বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ ক্রমশ বাড়ছিল। তথ্য বলছে,তখন দিল্লিতে প্রতিবছর ৫০, ০০০বিবাহ হতো , অথচ রেজিস্ট্রেশন হতো মাত্র ১৫০০।তাই বিবাহতে যেমন আইনত স্বীকৃতি পেতে রেজিস্ট্রেশন দরকার,তেমনই সামাজিক ধারা অব্যাহত রাখতে প্রথাকেও গুরুত্ব দেওয়া নাগরিক কর্তব্য,নাহলে আমরাই আমাদের সংস্কৃতি ধ্বংসের কারণ হয়ে থাকব। সাম্প্রতিক বিচারব্যবস্থার পর্যবেক্ষণ তাই যথেষ্ট ইতিবাচক।

Share this on social media

Facebook
Twitter
Email
WhatsApp
Telegram
Pinterest

Recent Posts

author-avatar
  • October 30, 2024

মাইক্রো ফিনান্স সংস্থার লোন নিয়ে চড়া সুদের চক্রে পড়ে সর্বসান্ত হচ্ছে গ্রাম বাংলার সাধারণ গরিব মানুষ।লোনের কিস্তি দিতে না পারলে বাড়ি বয়ে হুমকি দিয়ে যাচ্ছে মাইক্রো ফিনান্স সংস্থার কর্মীরা,অভিযোগ।রাত দশটা এগারোটার সময়েও এসে দরজায় কড়া নাড়ছে,অভিযোগ।আরও অভিযোগ,লোনের কিস্তি দিতে না পেরে মাইক্রো ফিনান্স সংস্থার কর্মীদের হুমকির ভয়ে অনেকেই ঘরছাড়া।আত্মীয় স্বজনের বাড়ি গিয়েও নিস্তার নেই ! সেখানেও হানা দিচ্ছে লোন আদায়কারীরা,দিচ্ছে হুমকি।লোন দেওয়ার সময় তাদের মোবাইল,টর্চ লাইট সহ বিভিন্ন আসবাবপত্র চড়া সুদে কিনতেও বাধ্য করা হচ্ছে বলে অভিযোগ।লোনের কিস্তির টাকা পরে দেব বললেও রেহাই পাচ্ছে না গ্রামের সাধারণ খেটে খাওয়া গরিব মানুষ।একটা লোন শোধ করতে গিয়ে নতুন করে আবারও লোন নিতে বাধ্য হচ্ছে তারা।লোনের কিস্তি আদায়ের নামে এভাবে কি যখন তখন বাড়িতে এসে হুমকি দিতে পারে মাইক্রো ফিনান্স সংস্থার কর্মীরা,উঠছে প্রশ্ন।চাপে পড়ে লোনের টাকা দিতে না পেরে যদি কেউ সুইসাইড করে তাহলে তার দায়িত্ব মাইক্রো ফিনান্স সংস্থার কর্মীরা নেবে তো, উঠছে প্রশ্ন।

author-avatar
  • October 30, 2024

ঘূর্ণিঝড় দানা’র প্রভাবে ক্ষয়ক্ষতি কতটা তা খতিয়ে দেখতে কৃষি মন্ত্রী ও পঞ্চায়েত মন্ত্রীকে জেলায় গিয়ে সমীক্ষা তদারকির নির্দেশ দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি।

author-avatar
  • October 30, 2024

আবাস যোজনায় দুর্নীতির অভিযোগে দিকে দিকে শুরু হয়েছে বিক্ষোভ।আবাস যোজনার সার্ভের কাজে যেন কোনো অস্বচ্ছতা না থাকে,সতর্ক বার্তা মন্ত্রী স্বপন দেবনাথের।

author-avatar
  • October 12, 2024

ধনেখালি ব্লকের মধ্যে অভিনবত্বের দিক থেকে আমাদের চোখে সেরা প্রতিমা দশঘরা স্কুল পাড়া দুর্গা পুজো কমিটির প্রতিমা।

author-avatar
  • October 12, 2024

বেপরোয়া বাইক চালকদের দৌরাত্ম্যে আতঙ্কিত পথ চলতি সাধারণ মানুষজন