পার্থ পাল
বাংলার এক প্রত্যন্ত গ্রামের অত্যন্ত গরিব ঘরের ছেলে সে। অল্প বয়সেই বাবা মারা গেলেন। মা বিয়ে করলেন কাকাকে। ঘটনাটি তার সহ্য হলো না। ভিড়ে গেল লেটো গানের দলে। গ্রাম্য ভাষায়, হালকা চলনে, নেচে নেচে এ গান গাওয়া হত। ছেলেটি সেখানে গান লিখল, পালা লিখল। জনপ্রিয়ও হল সেগুলি। তখনই আসানসোলের একজন রেলগার্ডের নজরে পড়ে গেল সে। তিনি ছেলেটিকে যত্ন করে বাড়ি নিয়ে গেলেন। এবং শেখালেন হারমোনিয়াম বাজানো। কিন্তু সেখানেও তার মন টিকলো না। চলে গেল কয়লা খনির শ্রমিক মহল্লায়। নেচে গেয়ে, আনন্দ দিয়ে তাদের মাত করে দিলেন। এবং এরই ফাঁকে তাঁর শেখা হয়ে গেল শ্রমিকদের মাদল বাদ্যযন্ত্রটির বোল। এরপর কাজ নিলেন কে এম বক্সের রুটির দোকানে। অমানুষিক পরিশ্রমের সাথেই চলল গানচর্চা। পরে, এক সহৃদয় দারোগার উদ্যোগে সে চলে গেল ময়মনসিংহ জেলার দরিরামপুরে। কিছুদিন সেখানে থেকেও মন বসলো না। চলে এলো সিয়ারশোলে। শুরু হল বিদ্যালয়ের শিক্ষা। কিন্তু শেষ হলো না। মাত্র তিন বছর পড়েই সে ব্রিটিশ সরকারের হাবিলদার হিসেবে চলল যুদ্ধক্ষেত্রে। ফিরে এসে শুরু হল কাব্যচর্চা। ততদিনে ছেলেটি ‘ সে ‘ থেকে ‘ তিনি ‘ হয়েছেন। তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়েছে ‘ ধুমকেতু ‘ পত্রিকায়। থাকেন কলকাতার মেসে। সঙ্গী, বিখ্যাত শ্রমিক নেতা মজফফর আহমেদ। মূলত আহমেদ সাহেবের সাহচর্যেই তিনি, নজরুল ইসলাম কিছুটা থিতু হলেন। নিরন্তর চলতে থাকল তাঁর সাহিত্যসৃষ্টি। তিনি উপহার দিলেন ‘ বিদ্রোহী ‘ কবিতা। বাংলার বিপ্লবীদের রক্ত টগবগ করে ফুটতে লাগল। প্রমাদ গুনল ব্রিটিশ সরকার। রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হল তাঁর। জেল ফেরত নজরুলের কলম শানিত হল আরও। এবার কবিতার সঙ্গে গানও লিখতে লাগলেন। পড়ে, মুখস্থ করে ফেললেন অধিকাংশ রবীন্দ্রসঙ্গীত! ‘ কুরআন ‘ যাঁর মুখস্থ, তাঁকে হাফিজ বলা হয়। মুজফফর আহমেদ সেই অনুসঙ্গেই নজরুলকে বলতেন ‘ রবীন্দ্রসংগীতের হাফিজ ‘। সমাজকে তিনি ঘুরে ঘুরে চিনেছেন। তাই সামাজিক বৈষম্য, জাতপাত, ধর্মীয় হানাহানি – গোঁড়ামির অসারতায় তিনি ব্যথিত হয়েছিলেন। সেই ব্যথা থেকেই সৃষ্টি হয়েছে অসংখ্য কালজয়ী কবিতা। তেমনই কয়েকটি আপাত কম পরিচিত নমুনা এখানে তুলে ধরা হল। ১ ▪ পুঁথির বিধান যাক পুড়ে তোর / বিধির বিধান সত্য হোক / খোদার উপর খোদকারী তোর -/মানবে না আর সর্বলোক। ২▪ জাতের চেয়ে মানুষ সত্য / অধিক সত্য প্রাণের টান / প্রাণ ঘরে সব এক সমান। ৩▪ ভগবানের ফৌজদারি কোর্ট নাই সেখানে জাত বিচার / (তোর ) পৈতে, টিকি, টুপি, টোপর সব সেথা ভাই একাক্কার! ৪▪ বলতে পারিস বিশ্বপিতা ভগবানের কোন্ সে জাত / কোন্ ছেলের তার লাগলে ছোঁয়া অশুচি হন জগন্নাথ। সাহিত্যজীবনে তিনি এমনই চিন্তাভাবনা প্রতিফলন রেখে গেছেন অগুন্তি। তিনি চাইতেন মানবধর্মে দীক্ষিত এক সাম্যবাদী সমাজ। যেখানে প্রত্যেকে প্রত্যেককে ভাই বলে বুকে টেনে নেবে। তাই চরম আশাবাদে তিনি লিখে গেছেন, ” যে লাঠিতে আজ টুটে গম্বুজ, পড়ে মন্দির চূড়া, / সেই লাঠি কালি প্রভাতে করবে শত্রুদুর্গ গুঁড়া। ” নজরুল ইসলাম তাঁর গানে যেমন নবী বন্দনা করেছেন তেমনি ভাব তন্ময়তার নিদর্শন রেখেছেন শ্যামাসঙ্গীত ও ভক্তিগীতিতে। তাঁর প্রথম সন্তানের নাম রেখেছিলেন কৃষ্ণমোহাম্মদ! কত বড় সাহসী ও আধুনিক মনন হলে তবে সেই সময়ে এই কাজ করা যায় পাঠক ভেবে দেখবেন। তাঁর সাহিত্য জীবন মাত্র তেইশ বছরের। ১৯৪২ সালে তাঁর ডিমেনশিয়া রোগ ধরা পড়ে। লন্ডন নিয়ে গিয়ে তাঁর উচ্চমানের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। যা ফলপ্রসু হয়নি। দেশে ফিরে শুরু হয় নিভৃত জীবনযাপন। বাংলার রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় এই দুঃসময়ে তাঁকে কিছুটা সহায়তা করেন। ১৯৭২ সালে নতুন বাংলাদেশ সরকার এদেশের সরকারের অনুমতি সাপেক্ষে তাঁকে বাংলাদেশে নিয়ে যায় ; এবং নাগরিকত্ব দেয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের ইচ্ছায় তাঁকে ‘একুশে পদক ‘ দেওয়া হয়। এদেশের ‘ পদ্মভূষণ ‘ এবং ওদেশের ‘একুশে পদক ‘ পাওয়া নজরুল ইসলাম সবার হৃদয়ে উজ্জ্বল আছেন ; থাকবেনও বহুকাল। আর এক প্রখ্যাত কবি অন্নদাশঙ্কর রায়ের ভাষায় বলা যায়, ” ভুল হয়ে গেছে বিলকুল / আর সবকিছু ভাগ হয়ে গেছে – / ভাগ হয়নিকো নজরুল।