খবর সোজাসুজি

চোখে চোখ রেখে কথা বলে !!!
চোখে চোখ রেখে কথা বলে !!!

নিরপেক্ষ নই ; শান্তির পক্ষে

পার্থ পাল

শরণার্থী শিবিরের এক চিলতে মাঠে ফুটবল খেলছিল এক দঙ্গল কিশোর। আপাতত শান্তির পরিবেশ। একটি ছেলের গোলার মত জোরালো শর্টে গোল হতেই উল্লাসে ফেটে পড়ল উপস্থিত সকলে। জালের আগল না থাকায় বলটি গিয়ে পড়ল খানিক দূরের ঝোপে। তা কুড়িয়ে আনতে ছুটলো ইউনুস। ঝোপের ভিতর থেকে বলটা কুড়োনোর সময়েই সে শুনতে পেল কান ফাটানো আওয়াজ। সে ঘুরে দেখল, চারপাশ ভরে গেছে ধোঁয়ায়। মৃত্যুযন্ত্রণার আর্তচিৎকারে ভারী হয়ে উঠেছে পরিবেশ। খানিক পরে ধোঁয়া কমতে সে দেখতে পেল তার এতক্ষণে খেলার সাথী, বন্ধুদের আর কেউ আস্ত নেই! চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে তাদের দেহাংশ। মাঠের ছিন্নবিচ্ছিন্ন ঘাস রক্তে লাল। এটি গল্পকথা নয় ; চূড়ান্ত ও সমসাময়িক বাস্তব। ঘটনাটি ঘটেছে প্যালেস্টাইন অধ্যুষিত গাজা ভূখণ্ডে। দীর্ঘদিন যাবৎ প্যালেস্টাইন ও ইসরায়েল – দুই পশ্চিম এশিয় প্রতিবেশী দেশের মধ্যে চরম পর্যায়ের রেষারেষি অব্যাহত। গত এক বছর ধরে তা রক্তক্ষয়ী। ইসরায়েল হামাস জঙ্গিগোষ্ঠীকে উচিত শিক্ষা দিতে চায়। অন্যদিকে হামাসরা গাজা ভূখণ্ডকে ব্যবহার করে ইসরায়েলকে ব্যতিব্যস্ত করতে চায়। এই দুই রাজনীতির টক্করে পড়ে উলুখাগড়া – সাধারণ জনগণের প্রাণ যায় মুড়ি-মুড়কির মতো। সেখানে কার কখন মৃত্যু হবে কেউ জানে না। এখন অবধি সেখানে উভয় পক্ষের মৃত্যু হয়েছে প্রায় একুশ হাজার জনের। গাজায় পোলিও টিকাকরণের জন্য যুদ্ধ বিরতিতেও সায় দেয়নি ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। স্কুলের আশ্রয় শিবিরে বোমা ছুঁড়েছেন তাঁরা। এমতাবস্থায় জাতিসংঘই বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছে ‘ গাজার কোন স্থানই নিরাপদ নয়।’ নিরাপদ নয় ছবির মত সৌন্দর্য্যের দেশ ইউক্রেনও। গত বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে রাশিয়ার সঙ্গে এদেশের যুদ্ধ বেঁধেছে। যা চলছে এখনও। মুহুর্মুহু মিসাইল হানায় গুঁড়িয়ে গিয়েছে রাজধানী শহর কিভের বহু বহুতল। রাশিয়ার ছোঁড়া ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র, ড্রোনবাহিত বোমা, এবং ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের আক্রমণে ব্যতিব্যস্ত ইউক্রেন। প্রত্যাঘাত করছে তারাও। এছাড়া বাঁচার যে কোনও উপায়ও নেই। কারণ, কথাতেই আছে- ‘শক্তি না থাকলে শান্তি থাকে না’। তবে সব ক্ষেত্রে সে সূত্র কাজে লাগে না। অর্থনৈতিক অবস্থান, জমির অধিকার বা জাতিগত বিদ্বেষও যুদ্ধের কারণ হয়। যেমন হচ্ছে আমাদের দেশের এক অঙ্গরাজ্য- মণিপুরে। গতবছরের মে মাস থেকে সেখানে কুকি ও মেইতেই নামের দুই জনগোষ্ঠীর মধ্যে লাগাতার সংঘর্ষ চলেছে। সে সংঘর্ষ রক্তক্ষয়ী। ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হানায় এ মাসেই এখন পর্যন্ত আটজনের মৃত্যু হয়েছে। রাজ্যে ‘ডাবল ইঞ্জিন’ সরকার থাকা সত্ত্বেও এ রক্তক্ষয়, অশান্তি থামছে না কেন – এ প্রশ্ন এখন জাতীয় স্তরে জ্বলন্ত। অশান্তি যে কেবল যুদ্ধকেন্দ্রিক হবে তারও কোনো মানে নেই। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ও বহু প্রাণঘাতী অশান্তি ডেকে আনতে পারে। যেমন এনেছিল তুরস্ক ও সিরিয়ায়। গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে এক ভয়ঙ্কর ভূমিকম্পে সেখানে প্রায় পঞ্চাশ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় বহু পরিবার। তার কিছুদিন পরেই নভেম্বর মাসে মরোক্কোয় মাঝারি মাপের ভূমিকম্পে প্রায় তিন হাজার মানুষ প্রাণ হারান। আফগানিস্তানে ভূমিকম্পে প্রাণ যায় দুহাজার জনের। মৃত্যু মিছিল সেখানকার সমাজ ব্যবস্থাটাকে নড়বড়ে করে দেয়। প্রাণে বেঁচে যাওয়া মানুষদের মাঝে নেমে আসে অশান্তির কালো মেঘ। বিশ্বজুড়ে তাপমাত্রার মাত্রাছাড়া বাড়বাড়ন্ত, বিধ্বংসী বন্যা, আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত, জনবিস্ফোরণের অসহ চাপ, উপায়হীন দারিদ্র্যের জীবন সংগ্রামও অশান্তির ইন্ধন। পেটের জ্বালায়, অন্ধকার ভবিষ্যতের আতঙ্কে মানুষ দলে দলে এক দেশ ছেড়ে অন্য দেশে পাড়ি দেয়। সেই দেশ এদের আপদ ভেবে দূরে ঠেলে। তখন রোহিঙ্গাদের মত কিছু দুর্ভাগা জাতি অশান্তির অনন্ত কৃষ্ণগহ্বরে ছটফট করে। শান্তি তাঁদের কাছে মরীচিকা মাত্র। তাহলে উপায়?

সমস্যা যেমন মানুষের মনে ; সমাধানও সেখানেই। আত্মসুখ, অতিলোভ, পরপীড়নের উল্লাস থেকে যুদ্ধ এবং দুর্ভিক্ষের সূত্রপাত। এই সমস্যার সহজ উত্তর- বিশ্বভাতৃত্ব। নিশ্চয়ই আমরা, আমাদের পরিবার, আমাদের জাতি, আমাদের দেশ সমৃদ্ধ হব ; হওয়ার চেষ্টা করবো। কিন্তু এই সমৃদ্ধির সুফল যেন প্রতিবেশী মানুষ তথা দেশ পায়। নইলে সে সমৃদ্ধি কখনোই আনন্দদায়ক হতে পারে না। প্রসঙ্গত কয়েকদিন আগে আমাদের প্রধানমন্ত্রী ইউক্রেন সফরে গিয়েছিলেন। তারও একমাস আগে তিনি রাশিয়া সফরেও যান। ইউক্রেনে তাকে প্রশ্ন করা হয়, “আপনি দুই যুদ্ধরত দেশেই সফর করলেন। অথচ কারও পক্ষ নিলেন না। তবে কি আপনি এবং আপনার দেশ এ ব‍্যাপারে নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়েছে? ” প্রধানমন্ত্রী তাতে সপাট জবাব দিলেন – ” আমরা নিরপেক্ষ নই ; আমরা শান্তির পক্ষে। ” হ্যাঁ, এটাই বিশ্বের এই বৃহত্তম গণতান্ত্রিক ও শান্তিবাদী দেশের প্রকৃত অবস্থান।

Share this on social media

Facebook
Twitter
Email
WhatsApp
Telegram
Pinterest