চারজন আমরা ট্রেনে চড়ে বসলাম নিউ জলপাইগুড়ির উদ্দেশ্যে | করোনার পর হাঁপিয়ে উঠেছিলাম বাড়িতে , তাই ঠিক করলাম আমি , আমার বৌমা / মেয়ে ( রোজী ) , আমার দিদি ( তৃপ্তিদি ) , আর নাতনি শরণ্যা দার্জিলিং ঘুরে আসি | আমার ছেলের বন্ধু হোটেলের ঘর বুক করে রেখেছে বললো , অতএব নিশ্চিন্ত | ট্রেনে রাতে উঠে খেয়ে ঘুমানোর চেষ্টা , আমার সেটা হয় না , এতো দুলুনি , তার উপর একটা নেশা ছোট্ট থেকে , রাতের প্রকৃতির সাথে একটু মোলাকাত করা , সারারাত তার সাথে চোখের উপর চোখ রেখে সময় কেটে যায় , অনেকদিন দেখা হয়নি | ভোরে তাকে বিদায় জানিয়ে প্ল্যাটফর্মে নেমে , গাড়িও বলা ছিল , তাতে চেপে রওনা দিলাম দার্জিলিং | আমার চরিত্র দোষ আছে মনে হয় , তাই দিনের প্রকৃতির প্রেমে মশগুল হয়ে পাঁচ ঘণ্টা কাটিয়ে গন্তব্যে পৌঁছে গেলাম | হোটেল ‘ পাইন্ ট্রি ‘ , বিশাল হোটেল , এখানে আগেও এসেছি , যিনি ম্যানেজার , ঘরের চাবি দেওয়ার সময় অনেকক্ষণ অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকায় আমার একটু সন্দেহ হয় , আমি প্রশ্ন করি কি ব্যাপার ! কোনও সমস্যা ? আমি তো আগেও এখানে এসেছি , উনি বললেন জানি তো , মুচকি হেসে চাবি দিয়ে বললেন , যান রেস্ট করুন , চা দিচ্ছে রুমে | যাচ্ছি যখন আমি বললাম , এদিকে তো কোনোদিন থাকিনি ! কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে বাঁ দিকের ঘর , ঢুকে দেখলাম আগের সাহেবদের বিশাল ঘর , একটি ঘরেই দুটি ডাবল বেড বড় বড় , ফায়ার প্লেস , বড় সোফা ,টেবিল , ড্রেস করার আলাদা জায়গা একটু এলাহি ব্যাপার | আমি বললাম আরে এই ঘরে থাকা তো প্রচুর পরিমাণে খরচ | রোজী বললো তুমি এতো এখন ভেব না, এটা তোমার ছেলের ব্যাপার , ওকে ভাবতে দাও I এরা সবাই জানে আমি কোথাও গেলে আগে ছবি ও ভিডিও করে নেওয়া আমার নেশা , ভিডিও শুরু করে দিয়েছি , ঘরের মধ্যে করে বাইরে গিয়ে করতে থাকলাম , ইংরেজ আমলের সবকিছু , এখনও সুন্দর করে গুছিয়ে রেখেছেন এঁনারা I সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসছেন কেউ , কাঠের সিঁড়ি , বুট জুতোর মচমচ আওয়াজ , তাই আমি ভিডিও করতে করতে সামনের দিকে সরে যেতে লাগলাম , পিছন দিয়ে যাওয়ার অসুবিধা যেন না হয় , আমার পাশে আসায় মুখ ফিরিয়ে দেখলাম ওঁনার যেতে অসুবিধা আছে কিনা , কিন্তু কেউ তো নেই ! আমার মনের ভুল কি ? হবে হয় তো , আবার উপর থেকে নিচে ভিডিও তুলে ঘরের বাইরে তুলে যাচ্ছি , সেই একই আওয়াজ , আমি তখন সিঁড়িটাই তোলার জন্য চেষ্টা করলাম , দেখি মনের ভুল কিনা ! কই , কেউ এলো না তো ! আমার গাটা শিরশির করে উঠলো , ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিতে বললাম সকলকে ম্যালে ঘুরে আসবো বিকালেই | দরজায় কলিং বেল , কফি দিয়ে গেল , রাতের খাওয়ার অর্ডার নিয়ে গেল I বেশ ঠান্ডা তাই কফিটা আরামদায়ক I তৃপ্তিদি বাথরুমে গেল , আমরা সেট করে নিচ্ছি , তৃপ্তিদি ওখান থেকে চেঁচাচ্ছে আরে লাইট অফ করলি কেন ? আমি বললাম আমরা করিনি , সুইচ তো দেওয়া আছে ! তবে কি সুইচের গণ্ডগোল ! ফোন করে বলায় , ওঁনারা এসে দেখে বললেন সব ঠিক আছে , যাওয়ার সময় তাকিয়ে একটু হেসে দিল , আমার খুব রাগ হতে লাগলো , কারণ , আমরা চারজনই মেয়ে I আমরা আবার তৈরি হতে থাকলাম , শেষে দিদি আবার বাথরুমে ঢুকে সেই এক চিৎকার , লাইট অফ করলি কেন ? আমি সয়েটার পড়তে গিয়ে পিছনে ফিরে দেখা মাত্র আমার নাতনির শরণ্যা চিৎকার আ আ করে , ওর দিকে তাকিয়ে দেখি ও শুয়ে পড়ে কম্বল মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে আমার দিকে আঙুল তুলে , পিছনে ফিরে তাকাতে দেখি একটা একটা করে লাইট অফ হয়ে যাচ্ছে , আমি খুব ভয় পেয়ে শরণ্যার কাছে ছুটে যাই , তৃপ্তিদিও ছুটে বেরিয়ে এসে দেখে সব অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে | আবার ঠিক হয়ে যায়, আমরা আবার আমাদের মনের ভুল ভেবে ম্যালে ঘুরতে যাই , কিন্তু মনে একটা খটকা ঘুরতে থাকে | সন্ধ্যা হয়ে যেতে ফিরে আসি , আমার অনলাইন কম্পিউটার পরীক্ষা আছে , এসে কফি খেয়ে আমি পরীক্ষা দিতে বসি , ওরা বিছানায় লেপের তলায় | আমার পরীক্ষা হওয়ার পর সাবমিট করেছি , হঠাৎ ফোনটা হাত থেকে পড়ে সব নষ্ট হয়ে গেল ! অনেক চেষ্টা করেও কিছু করতে পারিনি | রাত্রি ৯ টায় ডিনার দিতে এলো হোটেলের বয় , কি অস্বাভাবিক লম্বা ও সাদা আমি বলে বোঝাতে পারবো না , ওর চোখ দুটো কেমন , আমার আবার গা টা শিরশির করে উঠলো , আমি বললাম কাল সকাল হলেই চলে যাব , সকলেই ভয় পেয়ে আছে তাই রাজি হয়ে গেল , খেয়ে সকলে রুম হিটার চালিয়ে লেপের তলায় আশ্রয় নিল , আমি বাথরুমে গিয়ে দেখি সব জলের কল দিয়ে জল পড়ে যাচ্ছে , আমি বললাম , তোরা জল খুলে গেছিস কেন ? সকলেই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে , কেউ তো এমন করিনি ! আমি এসে সব বন্ধ করে শুলাম কিন্তু ঘুমাতে পারছি না , সারাদিনের ঘটনাগুলো মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে | বেশ রাত্রি , সুন্দর একটা মিষ্টি সুর ভেসে আসছে টুং টাং শব্দ করে , কাঁটা চামচ, কাপ ডিসের আওয়াজ , অনেক লোক মনে হচ্ছে যেন পার্টির মতো কিছু করছে , ঘড়ি দেখলাম ৩ টে বাজে , এখন তো এই সময়ে দার্জিলিং – এ কোনও হোটেলে কেউ আসবে না বা খাবে না, এদের একটা সময় বাঁধা আছে পাহাড় বলে | আবার সেই জুতোর মচমচ আওয়াজ , কান পেতে শুয়ে আছি , আমাদের ঘরের কাছে এসে থেমে যাচ্ছে ! আমি কাঠ হয়ে শুয়ে আছি , সকাল হওয়ার অপেক্ষায় , কখন একটু তন্দ্রা এসে যায় , ঘুম ভাঙে কলিং বেলের শব্দে , চা ও ব্রেকফাস্ট আসে , আমরা তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে ব্রেকফাস্ট করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসি | রিসেপশনে চাবি দেওয়ার সময় ওনারা অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে থাকায় আমি প্রশ্ন করি , আচ্ছা , কাল আমারা একটু অসুবিধা ভোগ করি ঘরে , আগেও এসেছি কিন্তু এমন তো হয়নি ! ওঁনার সাথে কথা বলে চোখ কপালে উঠে গেল | উনি বললেন , দেখুন এই হোটেলে ওই ঘরগুলোয় কেউ থাকতে পারেননি ! বিশেষ করে ১১১ নম্বর ঘর, যেটাতে আপনারা ছিলেন , ওইখানে আগে ইংরেজরা গুম করে রাখতেন বিপ্লবীদের , তাতে অনেকের মৃত্যু হয় , ওইখানে কেউ এক রাত্রি থাকতে পারেননি , তাই অবাক হয়ে গেলাম আপনারা কেন ওই রুমে এসে উঠলেন ! যিনি বুক করেছেন তিনি কি জেনে করেছেন ? আমি বললাম , আপনি কেন বলেননি ? উনি বললেন , আপনারা যে জানেন না , তা তো আমি জানি না ! সেইজন্য আমরা পাশে আবার ঘর তুলে নিয়ে আলাদা করে হোটেল বানিয়ে চালাচ্ছি , সেখানে কোনও অসুবিধা নেই | আপনাদের ভাগ্যভাল কিছু অঘটন ঘটে নি I আমি বলি , রাতে কি ওখানে কেউ পার্টি বা খাওয়া দাওয়া করছিল ? উনি বললেন, না না , ওদিকে কেউ সন্ধ্যার পর যায় না |