পার্থ পাল
আমাদের দেশ অনেক ব্যাপারেই বিশ্বসেরা। জনসংখ্যায় আমরা এ বছরই সেরার তকমা পেয়েছি। টপকে গিয়েছি চিনকে। আবার, মাটির নিচের জল ব্যবহারকারী দেশের তালিকাতেও আমরা একেবারে শীর্ষে। এই দুটি ব্যাপারেই ফার্স্টবয় হওয়াটা ভয়ংকর উদ্বেগের। যদিও তা পারস্পরিক। জনঘনত্ব ও মানুষের ভোগবাদী মানসিকতার প্রভাবে মাটির উপরের মিষ্টি জলের উৎসগুলির দশা এখন সঙ্গিন। সরকারি নথি জানাচ্ছে, বর্তমানে দেশের ২৫৬ টি জেলায় জলের অভাব রয়েছে। রাজ্যের কুড়ি লক্ষের বেশি পুকুর দীঘি কোনো না কোনোভাবে মানুষের অতিলোভের শিকার। চৈত্র মাসেই বাঁকুড়া, বীরভূম, পুরুলিয়া,ঝাড়গ্রামের মতো লালমাটির জেলাগুলিতে পুকুর, নদীর তলদেশ ফুটিফাটা। অথচ জেলাগুলিতে বছরে গড়ে পনেরশো মিলিমিটার বৃষ্টি হয়। তবে এমন হাড়ির হাল কেন! দোষটা অবলা আবহাওয়াকে দিয়ে লাভ নেই। দোষ আমাদেরই। আমরাই স্বখাতসলিলে ডুবে মরছি। আক্ষরিক অর্থে বলতে গেলে,জ্বলে মরছি। বিশিষ্ট বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা অনেক আগেই ধরেছিলেন রোগটি। তিনি বলেছিলেন, উদ্বৃত্ত জল আর সেই জলের অসমবন্টনই হচ্ছে আমাদের প্রধান সমস্যা। তাই ‘জল ধরো,জল ভরো’ এ রাজ্যে একটি স্লোগান মাত্র। বৃষ্টির শুদ্ধ জলকে আমরা অবহেলায় গড়িয়ে যেতে দিই। রাস্তার ধারের ট্যাপ কল থেকে সারাদিন ঝরে যেতে দিই পরিশুদ্ধ পানীয় জলকে। যে পুকুরে মাছ চাষ করলে বছরে লক্ষাধিক টাকা উপার্জন হতে পারত, তাকে শরিকি ঠেলাঠেলিতে সারগাদা বানিয়ে করেছি রোগের আগার। যে নয়নজুলির জলে খেলে বেড়াতে পারতো পুঁটি, মৌরলা, ট্যাংরার মত উপাদেয় মাছ, তাতে রাইস মিলের জল মিশিয়ে করে তুলেছি বিষাক্ত ; কালো। তবে কি মানুষ জল ছাড়াই জীবন চালাচ্ছে? তা তো নয়। আমরা বেছে নিয়েছি ভূগর্ভস্থ জলকে। সুইচ টেপো ; জল পাও। খাওয়া, স্নান,বাসনমাজা, কাপড় কাচা থেকে শুরু করে ফসলের সেচ – সবেরই জোগান দিচ্ছে পাতালের জল। রাজ্যে অনুমোদনযোগ্য নলকূপ সংখ্যা পাঁচ লক্ষ। বাস্তবে তা কত গুণ তা রাজ্যবাসীর সকলেই জানেন। তারই ফলশ্রুতিতে সমস্ত অগভীর নলকূপ আজ অকেজো। মাঠে, বাড়িতে রমরমিয়ে চলছে সুগভীর বা সাবমার্শিবল নলকূপগুলি। আলু,পাট,বাদাম,ধান সবই এখন গুচ্ছ-মিনি নির্ভর। খালবাহিত হয়ে নদীর জল না এলে জল ব্যবসায়ী চাষীদের পোয়া বারো! তবে সাবমার্শিবল নলকূপের দিনও শেষ হলো বলে। সৌজন্যে, কেন্দ্রীয় সরকারের সাধের প্রকল্প ‘জল জীবন মিশন’। ‘হর ঘর জল’ বা প্রত্যেক ঘরে জল পৌঁছে দিতে তৈরি হয়েছে অনেক বিশালাকার জলট্যাঙ্ক। রাস্তা কেটে বসানো হয়েছে পাইপ, বুস্টার স্টেশন। প্রায় প্রত্যেক বাড়িতে পৌঁছে গেছে জলের পাইপ, ট্যাপকল। এই প্রকল্প পূর্ণ শক্তিতে চললে ভূগর্ভস্থ জলের দশা হবে আরও সঙ্গিন। শুখা এলাকার জন্য এ মিশন অমৃতসম হলেও, এই সুজলা জেলাগুলিতে তা অতিরিক্ত ; বিষবৎ। কারণ ভূগর্ভের জল বেশি তুলে নিলে ভূত্বক শুকনো হতে বাধ্য। তখন আর পুকুর, দীঘিতে টলটলে জল থাকবে না। আবার পাতালের জলস্তর কমলে জলে বাড়বে আর্সেনিকের পরিমাণ। যার প্রভাব হবে মারাত্মক। নদিয়া জেলার সতেরোটি ব্লকের প্রত্যেকটিই আর্সেনিকপ্রবণ। এছাড়াও পানীয় জলে থাকছে নাইট্রেট, ফ্লুরাইডের মত নীরব ঘাতক। তাই এখনই সাবধান না হলে আমাদেরও আফসোসের শেষ থাকবে না। এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা যাক। গুজরাটের উত্তর অংশ, সৌরাষ্ট্র ও কচ্ছ এলাকায় এক সময় ভয়ংকর জলকষ্ট ছিল। দূর থেকে পানীয় জল বয়ে আনতে হত তাদের। গ্রীষ্মে জলাভাব অসহ হলে সরকার টাঙ্কারে করে জল সরবরাহ করত। এক বছর সমস্যা চরমে পৌঁছালে সরকারকে বিশেষ ট্রেনে করে জল সরবরাহ করতে হল। এবং সে বছরেই স্থায়ী সমাধানের উপায় খুঁজতে বাধ্য হল সরকার। অতি দ্রুততায় খোঁড়া হলো ‘সুজলাম সুফলাম’ খাল। বহু পুকুর, দীঘি তৈরি করা হল। জল ধরে রাখার ব্যবস্থা হল। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া রাজ্যবাসী কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সাহায্য করল সরকারকে। সেবার বর্ষায় দেখা গেল ভুজ শহরের হামিরসার হ্রদটি স্বচ্ছ জলে টইটুম্বুর। সে আনন্দকে যাপন করতে রীতি ভেঙে একদিনের ছুটি ঘোষণা করেছিল সরকার। সেই শুখা গুজরাট আজ জল সম্পদে সমৃদ্ধ।আমরাও চেষ্টা করলে পারি না কি?