তন্ময় কবিরাজ
দুর্নীতি এখন একটা সস্তা শব্দ।দুর্নীতি দেখে মানুষ আর আতঙ্কিত হয়না।বরং অবাক হয়ে দেখে কে কত বড় রকমের দুর্নীতি করছে। চারদিকে দুর্নীতির প্রতিযোগিতা চলছে।মানুষ তাই এক প্রকার দুর্নীতির প্রতিবেশী হয়ে থাকতে বাধ্য হচ্ছে। দুর্নীতির মধ্যেই মানুষ স্বপ্ন দেখে পরিবর্তনের।পরিবর্তন আসেও,তবে সেটা রাজনীতির পালাবদলের। শাসকের পর শাসক বদল হয়,নেতা মন্ত্রী ভোটের সময় কত বুলি আওড়ান কিন্তু দুর্নীতি কমে না, বরং বাড়ে। যত নেতা মন্ত্রীরা সৎ হবার প্রতিশ্রুতি দেন,ততই যেন দুর্নীতি বেড়েই চলছে।এ যেন ব্যাস্তনুপাতিক সম্পর্ক।যিনি দুর্নীতিমুক্ত হবার ডাক দিচ্ছেন তিনি নিজেই দুর্নীতির সঙ্গে অভিযুক্ত।এসবই এখন ট্রেন্ড, ভিউয়ারস বেশি।ক্ষমতা,নীতিহীনতা,দুর্নীতি এসব নিয়েই প্রশাসন চলছে,উন্নয়নের ফানুস উড়ছে চারদিকে।সাধারণ মানুষ খালি চোখে সে উন্নয়ন নাও দেখতে পারে, শাসক বলতেই পারে আমি অর্থনৈতিক উন্নয়ন চাই না,আমি অর্থনৈতিক বৃদ্ধিকে এগিয়ে রেখে বিশ্বে দাপিয়ে বেড়াব।শাসক যতই খারাপ কাজ করুক সে কিন্তু প্রচার এমন করবে তাতে যত খারাপই হোক নিজেকে সৎ প্রমাণ করেই ছাড়বে।আর সেই প্রচারের বুঁদ হয়ে মানুষও বোকা হয়ে যাবে। মানুষ যতই শিক্ষিত হোক, রাজনীতির কাছে সে নেহাতই শিশু। এখন মিথ্যা কথা বলা, মুখ খারাপ করা, ব্যক্তিগত আক্রমণ করাটাই ফ্যাশন, তা তিনি অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি হোন বা প্রবীন অধ্যাপক। পাবলিকের সামনে গা গরম করা দু’চারটে খারাপ কথা না বললে পাবলিক জানবে কেমন করে তাদের নেতা কেমন ভদ্রলোক!রাজনীতিতে এসব চলতেই থাকে।নেতা তো সোনার আংটি,বেঁকা হলেও ক্ষতি নেই।তাই বিবাহ বিচ্ছেদের পরে একসময়ের স্বামী-স্ত্রী একে অপরকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করছে। এসব হবে জেনেও দল তাদেরকেই প্রার্থী করে আর কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি দেখে। মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত যখন ইডি,সিবিআইকে বলছে অপরাধ প্রমানিত না হওয়া অব্দি ব্যক্তি সম্মান রক্ষা করতে হবে তখন বর্তমান রাজনীতিতে ব্যক্তি আক্রমণই প্রধান লক্ষ্য।বাংলার সংস্কৃতিতে নতুন সংযোজন।আসলে রাজনীতিতে নৈতিকতার কথা মুখে বলতে হয় কিন্তু সেই নৈতিকতা নিজে মেনে চলতে নেই। অন্য কেউ চুরি করলে চোর কিন্তু নিজে করলে সাধু,কিংবা চক্রান্ত। পারলে ডিগবাজি খেয়ে অন্য দলে ভিড়ে যাও। দেখবে তখন সাত খুন মাফ।সাধারণ মানুষের কাছে নেতাদের ভদ্রতা, সহনশিলতা শেখা উচিত।নেতারা এত নোংরামো করে বেড়ায় তারপরও সমাজ যে এখনো সুস্থ আছে সেটা সাধারণ মানুষের কৃতিত্ব। সাধারণ মানুষের হাতে ফালতু জিনিস নিয়ে ভাবার সময় নেই, তাদের কিভাবে সংসার চলবে তারা সেই নিয়েই চিন্তিত। এসব নেতাদের নিয়ে যদি জীবনী লিখতে হয় তাহলে ছাত্ররা যে কি লিখবে সেটাই দেখার। নেতারা মাঝে মধ্যে কুকথার জন্য ক্ষমাও চান ,তবে সেই ভুল আবার করেন।তাই ক্ষমার দাম থাকে না। ২০২৩ সালের তথ্য বলছে,১৮০টি দেশের মধ্যে ভারতবর্ষ দুর্নীতির তালিকায় ৯৩ তম স্থানে। অধ্যাপক মরিস দুর্নীতির সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন, দুর্নীতি ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য অবৈধ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ব্যবহার।তবে আজকের দিনে দুর্নীতি আর ব্যক্তিগত জায়গায় নেই। দুর্নীতি এখন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে।সমাজের উঁচু তোলা থেকে নিচু তোলা সবাই দুর্নীতির মধ্যে ডুবে গেছে।দুর্নীতির সুবিধা পাওয়াটা একটা সামাজিক অধিকারে পরিনত হয়েছে।আসলে জবাবদিহি করার ভয় নেই,তাই যা খুশি তাই কর।সংগঠনের জোর থাকলে ভোট প্রহসন হয়ে যাবে।এক সবজি বিক্রেতা সেদিন বলছে,”আমরা তো খেটে খেতে পারি, নেতারা তো আর খেটে খেতে পারবে না তাই মিথ্যা বলেই দিন কাটায়।” আগে মিডিয়ার সামনে নেতারা আসতো প্রশ্ন উত্তর পর্ব চলত।এখন সে মিডিয়াও পক্ষপাতদুষ্ট।শাসকের মিডিয়া তো আর সাধারণের কথা বলবে না।বরং মেয়েটা মারা গেলো সেটা তাদের প্রশ্ন নয়, প্রশ্ন মেয়েটি বিরোধী দলের।দুর্নীতির কবলে পরে প্রজন্মের পর প্রজন্ম শেষ হয়ে গেলো,সমাজে অবিশ্বাসের জন্ম হলো,কেউ সে কথা মনে রাখলো না,সবাই আইপিএলের মজাতে ডুবে আছে!কতো প্রতিভাকে হারালাম,কেউ হয়তো সমাজের মূল স্রোতে আসতেই পারলো না। কারন সবার রাজনীতির সাপোর্ট থাকে না, দূর্নীতিতে টাকা ঢালার ক্ষমতা নেই।মানুষ বুঝে গেছে, সাফল্যের সিঁড়ি অতিক্রম করতে হলে দুর্নীতির সঙ্গে দোস্তি করতে হয়।পরিস্থিতি এমন,কেউ যদি সৎভাবেও কিছু অর্জন করে মানুষ তাতেও দুর্নীতির গন্ধ পায়।এই রাজনীতি মানুষের মনকে এতোটাই বিষিয়ে দিয়েছে। শিক্ষা,স্বাস্থ্য,চাকরি,মেধা, পরিষেবা – সর্বত্র দুর্নীতি। মধ্য মেধার বিকাশ চলছে, কারণ তারা শাসকের অনুগত হতে পারবে।দুর্নীতির সঙ্গে প্রতিভার অসম লড়াইয়ে হেরে যাচ্ছে প্রতিভা।সমাজে হতাশা নেমে আসছে।সমাজ থেকে জীবন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। বাসযোগ্য সমাজকেই সে বসবাসের অযোগ্য বলে মনে করছে,সমাজকে সে সন্দেহ করছে।তাই তার মনেও তৈরি হচ্ছে ছিনিয়ে নেবার মানসিকতা।সমাজে সৎ লোকের যে অভাব তা নয়,সমাজে সৎ লোকেদের প্রথম সারিতে আনা হয়না। তারাই সমাজের প্রথম সারিতে থাকবে যারা শাসকের ইয়েস ম্যান। তারা সাধারণ মানুষের ব্রেইন ওয়াশের কাজ করবে।মানুষকে বিভ্রান্ত করবে। এইসব দুর্নীতি থেকে এখনই পালাবার কোনো রাস্তা নেই।এটা ক্যান্সার।অনেকে বলেন,মানুষের চেতনার বিকাশ হলে সব দুর্নীতির অবসান ঘটবে।কিন্তু তা ভুল। এসব চেতনা -টেতনা কিছু আঁতেল আছে, যাদের নিজেদের চেতনার বিকাশ হয়নি বা শাসকের কাছে নিজেকে বিক্রি করেছে কারণ চেতনার বিকাশ মুখে বললেই হয়না,এটা মাধ্যমিক পরীক্ষার রচনার শেষ লাইন নয়,এটা একটা দ্বন্দ্ব মূলক পদ্ধতি।তাই শাসকের শোষণ যত বাড়বে জীবন ততো দুর্বিষহ হয়ে যাবে। এখনও যে মানুষ সহ্য করছে কাল সে সহ্য করবে না।তখনই সে শাসকের এই সিস্টেম বয়কট করবে। যেমন করোনার সময় সব নিয়ম তুচ্ছ করে জীবনের জন্য মানুষ রাস্তায় নেমেছিল। তথাকথিত চিন্তাবিদরা ইতিহাস পড়লেও ইতিহাসকে বোঝেন না।মানুষ কিন্তু সব দেখছে,মানুষ জানে তার পাশে কেউ নেই।দিন কিন্তু ঘুরবেই। নবারুণ ভট্টাচার্য্যর কথাগুলো খুব মনে পড়ে, যারা লাথি মারে ইতিহাস তাদের মুছে ফেলে,যারা লাথি খায় তারা হাত মুঠো করে উঠে দাঁড়ায়।