বঙ্গ রাজনীতির চরিত্র নানা দিক থেকে বর্ণময়।কখন কীভাবে কী বদলে যাবে, আজকে যে শত্রু সে কাল যে কখন বন্ধু হয়ে যাবে ধরতে পারবেন না!বঙ্গ রাজনীতি যেন একটু বেশিই বেহিসেবি। ঠিক যেমনটা মুর্শিদাবাদ জেলার মুর্শিদাবাদ লোকসভা কেন্দ্রটি।সাতের দশক থেকে এই কেন্দ্রে সাপে-নেউলে সম্পর্ক ছিল বাম-কংগ্রেসের। নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাদ দিলেও দুই দলের কর্মীদের মধ্যে ছিল চির শত্রুতা। দুপক্ষের মধ্যে রক্তারক্তি, হাতাহাতি, বোমাবাজি ছিল রোজনামচা।কিন্তু ১৮ তম লোকসভা নির্বাচনের আগে সেসব যেন অতীত।বাম প্রার্থী মহম্মদ সেলিমকে জেতাতে ঘাম ঝরিয়ে মাঠে নেমেছে কংগ্রেসের নেতা-কর্মীরা। রাজনৈতিক মহলের দাবি, শূন্য থেকে শুরু করতে বামেদের বাজিই এই কেন্দ্র। তবে সেই খাতা খুলতে লাল শিবিরকে ভরসা রাখতে হচ্ছে সেই ‘শ্রেণি শত্রু’ কংগ্রেসের উপরই।১৯৫২ সালে লোকসভা নির্বাচনের সময় থেকে দু’দফায় মোট চারবার এই আসন ছিল কংগ্রেসের হাতে।এমনকী ঘোর বাম জমানায় ২০০৪ ও ২০০৯ সালে কংগ্রেস দখল নিয়েছিল মুর্শিদাবাদ লোকসভা কেন্দ্রটি। সাংসদ হয়েছিলেন মান্নান হোসেন। তার আগে ১৯৫২ এবং ১৯৫৭ সালে পর পর দুটি নির্বাচনে কংগ্রেসের মহম্মদ খোদাবক্স জয়ী হয়েছিলেন।পরে ১৯৬২ ও ১৯৬৭ সালে পর পর দুবার নির্বাচনে জয়ী হয়েছিল ইন্ডিপেন্ডেন্ট ডেমোক্রেটিস পার্টি। ১৯৭১ সালে জয়ী হয়েছিল ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন মুসলিম লিগ। আবার ১৯৭৭ সালে এই কেন্দ্র থেকে জয়ী হয়েছিলেন জনতা পার্টির কাজেম আলি মির্জা। সেবার লোকসভার মেয়াদ ১৯৮০ সালে শেষ হয়ে গিয়েছিল।
১৯৮০ সাল থেকে পরপর পাঁচবার সাংসদ ছিলেন সিপিএমের মাসাদুল হাসান। তার পরেও দুবার সদস্য ছিলেন মইনুল হাসান। ২০০৪ সালে জয়ী হয়েছিলেন কংগ্রেসের আবদুল মান্নান হোসেন। তিনি ২০০৯ সালের নির্বাচনেও জয়ী হয়েছিলেন। ২০১৪ সালে তৃণমূলের ভোট বৃদ্ধির ফলে কংগ্রেসের ভোটব্যাঙ্কে ধস নামে। ৩৩.৩৩ শতাংশ ভোট পেয়ে কেন্দ্রটির দখল নেয় সিপিএমের বদরুদ্দোজা খান। ২০১৯ এ প্রথমবারের জন্য তৃণমূল ৪১.৫৭ শতাংশ ভোট পেয়ে সাংসদ হন তৃণমূলের আবু তাহের খান।
সে বছর কংগ্রেস-সিপিএম পৃথকভাবে লড়াই করেছিল। পাঁচ বছর আগে তাদের প্রাপ্ত ভোটের অঙ্ক একসঙ্গে করলে হয় ৩৮.৪৪ শতাংশ। তৃণমূলের সঙ্গে মাত্র ৩.১৩ শতাংশ ভোটের তফাৎ। এবার তাদের মধ্যে পাকাপোক্ত ভাবে জোট হয়েছে। রাজ্যের যে কয়েকটি জেলায় মসৃণভাবে বাম-কংগ্রেস জোট হয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম এই মুর্শিদাবাদ।প্রার্থী হয়েছেন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক হেভিওয়েট মহম্মদ সেলিম। তাঁর প্রচারেও ঝড় তুলছে জোট। বৈশাখের তীব্র দাবদাহে উপেক্ষা করে বামেদের হয়ে প্রচারে নামছেন কংগ্রেসিরা। এমনকি সেলিমের হয়ে লাল উত্তরীয় পড়ে প্রচার মিছিলে হেঁটেছেন খোদ প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী। কংগ্রেসিরা যাতে ৭ মে ভোটবাক্সে কাস্তে-হাতুড়ি-তারা চিহ্নেই ভোটটা দেন, তা নিশ্চিত করতে জানপ্রাণ লড়িয়ে দিচ্ছেন কংগ্রেসের দলীয় নেতাকর্মীরাও। তবুও কি জোটের পথ মসৃণ?পুরো পথ ‘কন্টকময়’ না হলেও একেবারে মসৃণও নয়। এই পথে চলতে গেলে দু-চারটে কাঁটা ফুটবেই জোটপ্রার্থীর পায়ে ! যেমন জলঙ্গি পঞ্চায়েতের কৃষি কর্মাধ্যক্ষ গোলাপ শেখ।যাদের সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে হাতের আঙুল উড়ে গিয়েছিল,সেই বামদের সঙ্গে জোট মেনে নিতে পারেননি তিনি। সিপিএমের বিরোধিতা করে রবিবারই তিনি আইএসএফে যোগ দিয়েছেন। সাফ বলছেন, “এতদিন যাদের সঙ্গে লড়াই করলাম তাঁদের হয়ে প্রচার করতে পারব না। ভোটও দিতে পারব না।” তবে কংগ্রেসের একটা বড় অংশ বলছে, এবার মূল শত্রু বিজেপি ও তৃণমূল। তাই তাদের হারাতে মহম্মদ সেলিমের জন্য জান লড়িয়ে দেবেন।
এ প্রসঙ্গে কংগ্রেসের জেলা সাধারণ সলম্পাদক জাহাঙ্গির ফকির বলছেন, “দলের কর্মীরা সার্বিকভাবে জোট মেনে নিয়েছে। তাঁরা সিপিএমের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে প্রচার করছে।” একই কথা বলছেন জলঙ্গি ব্লক কংগ্রেসের সভাপতি আবদুর রজ্জাক মোল্লা। তাঁর কথায়,”জোট আমাদের কাছে সম্মানের লড়াই হয়ে দাঁড়িয়েছে।যার জন্য বৈশাখের এই ৪৪ ডিগ্রি তাপমাত্রা উপেক্ষা করে প্রতিনিয়ত মহম্মদ সেলিমের হয়ে কখনও যৌথভাবে, কখনও এককভাবে মানুষের সঙ্গে জনসংযোগ বজায় রেখে চলেছি।একটাই উদ্দেশ্য সেলিমকে একজন যোগ্য প্রার্থী হিসেবে সংসদে পাঠাতে চাই।”এই কংগ্রেসি নেতা-কর্মী-সমর্থকদের উপর ভরসা করেই আশার জাল বুনছে বামেরাও মনের কোণে কোথাও আশা জমছে,পাঁচ বছরের অপেক্ষার পর হয়তো এবার খাতা খুলবে।হয়তো এবার ‘জমিদার’ কংগ্রেসি ভোটের সেতুতে চড়ে সংসদে পৌঁছে যাবেন ‘সর্বহারা’দের প্রতিনিধি মহম্মদ সেলিম !