জ্যোতিরিন্দ্রনারায়ণ লাহিড়ী
অনেকে আমার কাছে প্রায়ই জানতে চান বছরের কোন সময় সুন্দরবন দেখতে যাওয়ার জন্য সঠিক।আমার কাছে সুন্দরবন সব ঋতুতেই অপরূপ৷প্রকৃতপক্ষে সুন্দরবন প্রতি মুহূর্তে তার রূপ পরিবর্তন করে৷একথা আক্ষরিক অর্থেই সঠিক৷ জোয়ার-ভাটার এই দুনিয়ায় ঋতু পরিবর্তনের জন্য অপেক্ষায় থাকতে হয় না, প্রতি মুহূর্তেই বদলে যায় ভূদৃশ্য৷ আর সব সময় এবং সব ঋতুতেই আলাদা আলাদা রূপ রস গন্ধ নিয়ে অপেক্ষায় থাকে মায়বী সুন্দরবন৷
বাংলার উপকূলে রয়েছে পৃথিবীর বৃহত্তম একটানা বিস্তৃত ম্যানগ্রোভ অরণ্য সুন্দরবন৷ ইউনেস্কোর বিচারে বিশ্ব ঐতিহ্যের শিরোপা পাওয়া এই জঙ্গল একাধারে যেমন পর্যকটকদের চিরকালীন আকর্ষনের কেন্দ্রবিন্দু তেমনই পৃথিবীর ভূজীববৈচিত্র্যের ক্ষেত্রেও একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ভৌগোলিক অঞ্চল৷
এই বিস্তীর্ন বনাঞ্চলে ছড়িয়ে আছে বিভিন্ন প্রজাতির লবণাম্বুজ উদ্ভিদ।এই সব উদ্ভিদের মধ্যে সুন্দরি, গরান, গোলপাতা, হেঁতাল, ধানিঘাস, কেওড়া, গর্জন,ধুন্দল, হরগোজা ইত্যাদি বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
সুন্দরবন পৃথিবীর বৃহত্তম উপকূলীয় জলাভূমি ৷ সুন্দরবনে এক সময় পাওয়া যেত ভারতীয় একশৃঙ্গ গন্ডার, জাভান গন্ডার, বন্য মহিষ, চিতা বাঘ,হগ ডিয়ার,বার্কিং ডিয়ার,বারশিঙ্গার মত প্রাণী। উজানের সুপেয় জল আর সাগরের লবণাক্ত জলের মিশ্রণে গড়ে উঠেছে সুন্দরবনের বিরল বাস্তুসংস্থানতন্ত্র,কিন্তু কয়েক শতাব্দী ধরে গঙ্গার মূল ধারা পদ্মার খাত ধরে বাংলাদেশের দিকে বয়ে চলেছে। শুকিয়ে গেছে ভৈরব,জলঙ্গী, মাথাভাঙা,চূর্ণী, ইছামতী, যমুনা, বিদ্যাধরী, আদিগঙ্গা ও ভাগীরথীর অনেক উপনদী। ফলে কমেছে সুপেয় জলের যোগান, বাড়ছে সুন্দরবনের নদীতে লবণতা। সম্ভবত এই পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারেনি বলেই ওইসব প্রাণী সুন্দরবন থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে৷ তবুও সুন্দরবনের প্রাণীদের বৈচিত্র্য এখনও আমাদের বিস্মিত করে। বিশ্বব্যাঙ্কের সাম্প্রতিক রিপোর্ট থেকে জানা যায়
ভারতের ১০% স্তন্যপায়ী প্রাণী আর ২৫% পাখী-প্রজাতি সুন্দরবনে দেখা যায়৷ সুন্দরবনের রয়াল বেঙ্গল টাইগার এবং কয়েক ধরনের ডলফিন আজও সারা পৃথিবীর পর্যটকদের কাছে বিশেষ আকর্ষনের কেন্দ্রবিন্দু। ভারতীয় প্রাণী সর্বেক্ষণ সংস্থা (জেড এস আই) ভারতীয় সুন্দরবনে বর্তমানে আড়াই হাজারেরও বেশি প্রাণী-প্রজাতির সন্ধান পেয়েছেন৷
উদ্ভিদ ও প্রাণীর ব্যাপক বৈচিত্র্যের সঙ্গে সঙ্গে সুন্দরবনের ভারতীয় অংশকে এক অনন্য বিশিষ্টতা প্রদান করেছে এই জঙ্গল সংলগ্ন অংশে বসবাসকারী প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ মানুষ৷ পৃথিবীর কোনও ঘন অরণ্যের পাশে, বিশেষত যেখানে রয়াল বেঙ্গল টাইগারের মত প্রাণী বসবাস করে সেখানে মানুষের এত ঘন বসতি দেখতে পাওয়া যায় না৷ গত প্রায় আড়াইশো বছর মানুষ এবং জঙ্গলের এই সহাবস্থান চলছে।
সুন্দরবন সংলগ্ন অংশে মানুষের বর্তমান বসতির পথ চলা পলাশীর যুদ্ধের পর ইংরেজদের হাত ধরে। তবে সুন্দরবনের গভীর জঙ্গলের মধ্যে প্রাচীন সভ্যতার বেশ কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া গেছে, এই নিদর্শনগুলি সুন্দরবনে অতীত মনুষ্যবসতির নিদর্শন হিসাবে ধরা হলেও তা ঠিক কত বছরের প্রাচীন তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতপার্থক্য আছে। খ্রীষ্টপূর্ব ৩০০ থেকে ১২০০ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে এই সভ্যতার সৃষ্টি ও ধ্বংস হয়েছিল বলে ঐতিহাসিকরা বিভিন্ন সময়ে মত প্রকাশ করেছেন। এ এক অমীমাংসিত প্রশ্ন যে আজ যে অঞ্চল সাগরের গড় জলস্তর থেকে মাত্র দুই থেকে চার মিটার উঁচুতে অবস্থিত এবং প্রতিটি জোয়ারে কয়েক ফুট জলের নিচে অবস্থান করে, সেখানে কিভাবে একটি সভ্যতার জন্ম হয়েছিল এবং তা টিকে ছিল। তবে কী সাগর সেই সময় আরও দক্ষিণে ছিল বা ভূমি এই সময়ের তুলনায় উঁচুতে অবস্থান করত ? এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা অত্যন্ত জরুরী।
এই সব অমীমাংসিত প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে সুন্দরবন পরিক্রমা আরও বেশি আকর্ষনীয় হয়ে ওঠে। আজও সুন্দরবনের গভীর জঙ্গল পরিক্রমায় দেখা মেলে অতীত দিনের মাটির তৈরি নানা গৃহস্থালীর জিনিসের অংশ বিশেষের। সুন্দরবনের প্রত্যন্ত গ্রাম গ্রামান্তরে দেখা মেলে সাধারণ মানুষের সংগ্রহ করে রাখা এমনই সব ইতিহাস চর্চার মূল্যবান উপাদানের৷
ভূতাত্ত্বিকদের মতে এই অঞ্চল পৃথিবীর বৃহত্তম গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা বদ্বীপের এমন এক অংশ যেখানে ভূমি গঠনের কাজ এখনও শেষ হয়নি। তাই এলাকাটিকে সক্রিয় বদ্বীপ বলা হয়।এ পর্যন্ত প্রায় পাঁচ লক্ষ ঘন কিলোমিটার পলি সঞ্চিত হয়েছে পৃথিবীর বৃহত্তম এই বদ্বীপ গঠনের কাজে।নদী এবং সমুদ্রের মিলিত সঞ্চয়কাজের ফলে সুন্দরবন বদ্বীপ গত দু’কোটি বছরে ক্রমশ দক্ষিণ দিকে তার আয়তন বৃদ্ধি করে চলেছে৷ তবে সুন্দরবনের ভারতীয় অংশের পশ্চিমদিকের দ্বীপগুলি ভূমির অবনমন এবং সাগরের জলস্তরের উত্থানের কারণে ক্ষয়ের সম্মুখীন হচ্ছে৷ অন্যদিকে বাংলাদেশ অংশের দক্ষিণ দিকে ক্রমাগত চলেছে সঞ্চয়ের প্রক্রিয়া।
সুন্দরবন পরিক্রমায় এই ভাঙাগড়া খেলা আমাদের ভূগোল বইয়ের পাঠকে যেন বাস্তবের মাটিতে এনে দাঁড় করায়৷ মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে একটি অঞ্চলের ভূদৃশ্য কীভাবে বদলে যায় সেকথা না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না৷ শুধু ধ্বংস নয় একই সঙ্গে দেখা যায় নতুন ভূমি জেগে ওঠার দৃশ্যও।
ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে সুন্দরবনকে মোকাবিলা করতে হয়ে বহু প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের৷ সুন্দরবন সংলগ্ন অঞ্চলে বসবাসকারী কয়েক লক্ষ মানুষ বিপর্যয়কে সঙ্গে নিয়ে বেঁচে থাকার নানা আশ্চর্য পদ্ধতি খূঁজে নিয়েছেন৷ বারবার ঘূর্ণিঝড়, অতিবৃষ্টির মত বিপর্যয়ে বিধ্বস্ত হওয়ার পর এক আশ্চর্য জীবনী শক্তিকে ভর করে টিকে আছেন সুন্দরবনের মানুষ৷ জঙ্গলের সঙ্গে রয়েছে তাঁদের এক অসাধারণ সহাবস্থান। জল-জঙ্গল থেকে যেমন তাঁরা আহরণ করেন মাছ বা মধু তেমনই এই জঙ্গলকে তাঁরাই আগলে রাখেন পরম মমতায়।
গোটা পৃথিবীর যেসব অঞ্চলের মানুষের উপর বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের কুপ্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ছে তারমধ্যে একেবারে প্রথম দিকে আছে সুন্দরবন৷ হাজার প্রতিকূলতার মাঝে তাঁদের এই টিকে থাকার অদম্য লড়াই সুন্দরবন পরিক্রমায় যে কোনও সচেতন মানুষেরই দৃষ্টি এড়াবে না৷
আজ যাঁরা সুন্দরবন অঞ্চলে বসবাস করছেন তাঁরা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বাধ্য হয়ে অথবা স্বেচ্ছায় একটু স্বাচ্ছন্দ্য ও নিজস্ব জমির খোঁজে এই অঞ্চলে এসেছিলেন৷ দীর্ঘদিন একটি বিশেষ ভৌগোলিক অঞ্চলে বসবাস করতে করতে তাঁদের মধ্যে গড়ে উঠেছে এক অদৃশ্য বিনিসুতোর বন্ধন, যা তাঁদের লোকাচার, বিশ্বাস বা ধর্মাচরণে প্রকাশ পায়৷ প্রতিকূল পরিস্থিতিতে টিকে থাকার বাসনায় জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে বনবিবি বা দক্ষিণরাইকে আরাধনা করা তেমনই এক লোকাচার৷ জঙ্গল সংলগ্ন সুন্দরবনের গ্রাম পরিক্রমায় গ্রাম বা জঙ্গলের আনাচে কানাচে এমনই নানা লোকদেবতার মন্দির, মাজার, থান চোখে পড়ে যা সুন্দরবনের আকর্ষণকে আরও কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়৷
ভাঙা গড়ার এই সুন্দরবনে জীবন অনিশ্চয়তায় ভরা৷ তবু এর টান অমোঘ৷ যেসব মানুষ দীর্ঘদিন ধরে এই অঞ্চলে নানা প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে আছেন তাঁদের মতই যাঁরা প্রকৃতির টানে বারবার সুন্দরবনে ছুটে যান তাঁদের সকলকেই সুন্দরবন তার মোহময় আকর্ষণের অদৃশ্য চুম্বকে টেনে রাখে৷ বারবার তাই ফিরে আসা এই চিরন্তন সুন্দরবনে৷৷
(বিশেষ দ্রষ্টব্য – লেখক “শুধু সুন্দরবন চর্চা” পত্রিকার সম্পাদক৷পূর্ব বর্ধমানের পলাশন এম.এম.হাইস্কুলের ভূগোলের শিক্ষক৷)